শাল্লার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় অকন বেশি মানুষ দেখলেই ভয় লাগে
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার সাম্প্রদায়িক হামলার
নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জয় সিন্দু দাশ। গত ১৭ মার্চে গ্রামে হামলার ভয়াবহতা ভুলতে পারছে না সে। একসাথে শতশত চিৎকার, টিনের ঘরে ভাঙচুরের শব্দ এখনও তার কানে বাজে।
জয় বললো, অন্যদিনের মতোই বাড়ির উঠানে খেলা করছিলো। হঠাৎ করে একসঙ্গে অনেক মানুষের চিৎকার শুনতে পায় সে। কিছু বুঝতে পারার আগেই তাকে ও অন্য বোনদের নিয়ে তার মা হাওরের দিকে ছুটতে থাকেন। এরকম ভয়াবহ হামলার কারণ বুঝতে না পারলেও মানুষের হিংস্রতা মনে দাগ কেটেছে তার।
জয়ের মা রীনা রানী দাস বলেন, হাতে দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র¿ নিয়ে দেখতে দেখতেই নদী পার হয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। তখন শুধু মনে হয়েছে বাঁচতে হবে। আমার ছোট মেয়ে ও ছেলে কে নিয়ে হাওরের ধান ক্ষেতে গিয়ে লুকিয়েছি জীবন বাঁচাতে। একই ধরণের কষ্টের কথা বর্ণনা দিলেন, গ্রামের টিটন চন্দ্র দাশ ও তার স্ত্রী ঋতু রানী দাশ। বললেন, ক্লাসে ওয়ানে পড়া তার ছেলে রাজ কুমার দাশ, শব্দ শুনলেই দৌড়ে বের হয়।
নোয়াগাঁও গ্রামের বায়োজ্যেষ্টরা বিভীষিকাময় ঘটনা ভুলে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে। কিন্তু শিশু ও শিক্ষার্থীরা এখনও রয়েছেন আতংকিত।
অভিভাবকরা জানালেন, ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করতে পারছে না। একা একা কোথাও বেরও হয় না। সব সময় আতংকে থাকে। ঘুমের মাঝেও চিৎকার দিয়ে ওঠে তারা।
গিরিশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সনকা রানী দাস বলেন, সামনে আমার এসএসসি পরিক্ষা। রাতে একটু একা হলেই মনে হয় এই বুঝি আবারও হামলা হলো। পড়তে পারি না।
একই বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিশির বাবু দাস বললো, হামলার সময় হাওর পাড়ি দিয়ে আরেক গ্রামে যাই। ফিরে দেখি সব বই- খাতা ছিড়া। এখন স্কুল খুললে আমরা কিভাবে স্কুলে যাবো? রাস্তায় মানুষ দেখলেই ভয় করে।
নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী অমিত চন্দ্র দাস জানালো, একই রকমের আতংকের কথা। সে বললো, হামলার সময় মায়ের সাথে পাশের গ্রাম কোরারপাড়ায় পিসির (ফুফুর) বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তারা। ১ দিন পর বাড়িতে এসেছে। দেখলো বই খাতা সবকিছু ছেড়া। কেনো এমন হামলা এখনও আঁচ করতে পারছে না সে।
শিক্ষার্থী মনিকা দাস বলেন, দুর্বৃত্তরা আমার এডমিট কার্ড ছিড়ে ফেলেছে। সামনে আমার এইচ এস সি পরীক্ষা, এনিয়ে চিন্তায় রয়েছি। এডমিট কার্ড না হলে পরীক্ষা দেয়া যাবে না।
অভিভাবক রীনা রানী দাস বলেন, ‘আমার মেয়ের মেট্টিক পরীক্ষার ফরম ফিলআপ সামনে। মেয়ে বলে, মা আমি ঘুংগিয়ারগাঁও যাইতাম কেমনে ডর (ভয়) লাগের’।
সব ঠিক হয়ে যাবে বলে মেয়েকে সাহস দিচ্ছেন বলে জানালেন তিনি।
গ্রামের রিপন রানী দাস বললেন, ‘হামলার সময় আমরা ধান ক্ষেতে লাম্বা হইয়া শুয়ে রইছিলাম। বাচ্চা বলে পানি খাইতো, পরে ক্ষেত থেকে প্যাকের পানি খাওয়াইছি, এখন তো সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে, তবু বাচ্চারাতো ভয় পায়, রাতে ঘুমায় না, ঠিক মতো খায়ও না, শুধু বলে মা, আবার নি আইয়ে, আমি কই, না আর আইতো নায়। এখন তো পুলিশ আছে, পুলিশে মাইরা দিব।
বললেন,এভাবেই শান্ত¡না দিয়ে রাখি ছেলেকে। তবু ঘুমায় না।
হবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল বললেন, শিক্ষার্থীদের বই পত্রও ছিড়ে ফেলেছে। ভবিষৎ নিয়ে শিশুরাও আকংকিত রয়েছে। প্রশাসন ত্রাণপত্র যা দিচ্ছেন তা পেয়ে আমরা সন্তোষ্ট রয়েছি। শিশুদের মানসিকভাবে সহযোগিতা প্রয়োজন।
নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গুরুপ্রসাদ দাস বলেন, আমার বিদ্যালয়ে মোট ৯২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। সকল শিক্ষার্থীই নোয়াগাঁও গ্রামের। গ্রামে ১৭ মার্চের হামলা ও লুটপাটের কারণে মানসিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা, গ্রামের বাসিন্দারা বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন, তাতে তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষাচ্ছেন, কিন্তু শিশুরা এতোসব বুঝে না। কেনো এরকম ঘটনা হলো বুঝেনি, বিদ্যালয় খুললে শিক্ষার্থীদের মানসিক সার্পোট দিতে পারবো।
সুনামগঞ্জের শিক্ষাবিদ ন্যাথালিয়ন এডউইন ফেয়ার ক্রস বলেন, এরকম ঘটনা আমরা আশা করি না। শিক্ষার্থীদের মানসিক সাপোর্ট দেওয়া জরুরি। এই ধরনের কোনো ঘটনা ভবিষতে যেনো না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে প্রশাসনকে।