সুনামগঞ্জের শাল্লায় হাওরে ধান কাটা মাড়াই জোরেশোরে শুরু হওয়ায় কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজ চলছে হাওরপাড়ের বাজারে বাজারে। স্থানীয়ভাবে ওয়ার্কসপ গুলোকেও লকডাউনের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ যন্ত্রণায় অতিষ্ট ওয়ার্কসপ মালিকসহ কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত করতে আসা কৃষকরা ক্ষুব্ধ।
কৃষকরা বলেছেন, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের।
মঙ্গলবার সকালে আঙ্গারুয়া নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক নিতেশ দাশ একটি ট্রলিগাড়ি ও একটি ধান মাড়াই মেশিন মেরামত করতে পাশের আনন্দপুর বাজারের নিউ স্বস্তিওয়ার্কসপে এসেছিলেন। সকালে বিদ্যুৎ না থাকায় ২ ঘণ্টা ওয়ার্কসপে বসে কোন কাজ না করেই হাওরে ধান কাটতে চলে যান। ধান কাটা শেষে আবার বিকাল ৬ টায় আসেন আনন্দপুরের নিউ স্বস্তিম ওয়ার্কসপে। তখনও এসে বাজারে বিদ্যুৎ নেই দেখতে পান তিনি। রাত ১০ টা পর্যন্ত বাজারে বসে মনের কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরেন এই কৃষক। পর দিন বুধবার ভোরে গিয়ে কোন রকমে কাজ শেষ করেছেন বলে জানান।
এসময় আনন্দপুর
গ্রামের আরেক কৃষক পিন্টু দাশ নতুন টিলারের চাকা ট্রলিতে বসানোর উপযুক্ত করার জন্য মঙ্গলবার সকাল ৬ টায় এসে বসেছিলেন নিউ স্বস্তিম ওয়ার্কসপে। তার আসার আগেই ভোরে আরও কয়েকজন কৃষক তাদের কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত করার জন্য এই ওয়ার্কসপে এসে বসেছেন। সকালে এসে দেখেছেন কিছুক্ষণ বিদ্যুৎ ছিল। অন্যরা কাজ করেছে। পরে দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ ছিল না। সকাল ১০ টায় বিদ্যুৎ আসলেও ওয়ার্কসপে আগে আসা কৃষকদেন কাজ আগে করছিলেন ওয়ার্কসপ মেস্ত্রীরা। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চাকাগুলো রেখে গেলে চলে যান। তিনি বলেন বিদ্যুৎ না থাকলে কাজ হবে না, বেকায়দায় পড়ে আছি, হাওরে কাটা ধান পরে আছে। এখনকার এক ঘণ্টা সময় অন্য সময়ের এক সপ্তাহের সমান, যারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করেন, তারাতো সেটি বুঝবেন না।
নিউ স্বস্তিম ওয়ার্কসপের মালিক মৃদুল কান্তি দাস বললেন, ধানা মাড়াই মেশিন, (বোমা) রিপার মেশিন (ধান কাটার মেশিন,
ট্রলি, ঠেলাগাড়িসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে ওয়ার্কসপের সামনে ভিড় কৃষকগণের। অন্য সময় ২ জনে কাজ করতাম । এখন কাজের সময় হওয়ায়
৪ জনে কাজে করছি । ৬ টা থেকে রাত ১ টা পর্যন্ত দোকানে কাজ করতে হয়। বিদ্যুৎ থাকলে সকলের কাজ শেষ করতে পারি, আমরাও জনপ্রতি ২-৩ হাজার টাকা রোজগার করি। বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদেরও রোজগার নাই, কৃষকরা যারা আসেন তারা ও ভোগান্তিতে পড়েন। সকালে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। দিনের বেলা বিদ্যুৎ আসা যাওয়া করেছে। সন্ধ্যার পর ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এভাবে কাজ করা কঠিন। এই বাজারের আরেকটি ওয়ার্কসপ’এর মালিক সুভাস দাসও একই ধরনের কষ্টের অনুভূতি জানালেন।
ওয়ার্কসপের মালিক মৃদুল ও সুভাস বললেন, কেবল আনন্দপুর বাজার নয়, হাওরাঞ্চলের উপজেলা সদর থেকে শুরু করে হাওরপাড়ের বড় বাজারগুলোতে থাকা ওয়ার্কসপ গুলোতে কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য কৃষকদের সমান ভিড়। কিন্তু বিদ্যুতের ভোগান্তি আছে বাজারে বাজারে। অথচ. কৃষকের এখন প্রতিমূহূর্ত হিসাবের সময়, যন্ত্রপাতি মেরামত করার জন্য কারো বসে থাকার সময় নেই। আবার যন্ত্রপাতি ছাড়া চলারও উপায় নেই। কৃষকদের প্রয়োজনেই আগামি কয়েকদিন নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন।
আনন্দপুর বাজার সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিকাশ চক্রবর্তী বললেন, কৃষকের এখনকার একদিন, অন্যান্য সময়ের ১৫ দিনের সমান। সরকার কৃষকদের প্রয়োজন মেঠাতে কৃষি যন্ত্রপাতির দোকান এবং ওয়ার্কসপ গুলোকে লকডাউনের আওতামুক্ত রেখেছেন। কিন্তু নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ না পেলে ওয়ার্কসপগুলো কৃষকদের চাহিদা মেঠাতে পারবে না।
সুনামগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের জিএম সজিব কুমার বিশ্বাস বললেন, ১১ তারিখের ঝড়ে ছাতক-সুনামগঞ্জের ১৩২ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কয়েকটি টাওয়ার পড়ে যায়। এরপর থেকে একটি সার্কিট দিয়ে চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে এই জেলায়। পাওয়ার গ্রীড কোম্পানী অব বাংলাদেশের ৪০-৫০ জন যন্ত্র প্রকৌশলী কাজ করছেন এই সঞ্চালন লাইন স্বাভাবিক করতে। এই দুর্ভোগের কারণে সুনামগঞ্জ সদর সহ পুরো ভাটি অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিকভাবে করা যায় নি। লোডশেডিং করতে হয়েছে। আশা করা হচ্ছে আজ বুধবার থেকে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরন হওয়া যাবে।
সুনামগঞ্জ বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান বললেন, জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হলে কৃষি প্রধান এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা থাকবে।
সুনামগঞ্জে এবার তিন লাখ ২৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে ধানের চাষাবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক উৎপাদন হলে কেবল সুনামগঞ্জ নয়, সারাদেশের খাদ্য চাহিদা মেঠাতে ভূমিকা রাখবে এই জেলার উৎপাদিত বোরো ফসল।