এই নিয়ে চারবার স্বামীকে হাসপাতালে ভর্তি করাইছি। এখন স্বামীকে চিকিৎসার জন্য সিলেট নিয়ে যে যাব, সে টাকা নেই। একটা গাড়ি (ইজিবাইক) আগে বিক্রি করে চিকিৎসা করাইছি। এখন আরেকটা গাড়ি আছে, সেটাও বিক্রি করার চেষ্টা করছি। বিক্রি করতে পারলে সিলেট নিয়ে চিকিৎসা করাব।’
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের একমাত্র নারী ইজিবাইক চালক যাত্রী রানী দত্ত বলেছেন এভাবে। জেলা শহরের এমন কেউ নেই তাকে চেনেন না। শত প্রতিকূলতার মাঝেও করোনা পরিস্থিতিতে ৬ সদস্যের পরিবার নিয়ে লড়াই করছেন টিকে থাকার জন্য। কিন্তু সে লড়াইয়ে ধীরে ধীরে হেরে যাচ্ছেন যাত্রী।
কারণ, তার স্বামী হৃদয় চন্দ্র দত্তের শরীরে বাসা বেঁধেছে রোগ। সে রোগ সারাতে অনেক টাকা প্রয়োজন। কিন্তু সে সাধ্য নেই যাত্রীর। সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন হৃদয় চন্দ্র দত্ত।
তাহিরপুর উপজেলার টেকাটুকিয়া গ্রামের দেবেন্দ্র বর্মণ (মৃত) ও শুভা রানী বর্মণের বড় মেয়ে যাত্রী। তার বয়স যখন আট বছর, তখন তার বাবা মারা যান। সেই থেকে তার সংগ্রাম শুরু হয়। পাথর ভাঙা, অন্যের বাসায় কাজ, মেসে রান্না করাসহ সব কাজই করেছেন যাত্রী। এখন শহরের নবীনগরে স্বামী, মা ও তিন সন্তানকে নিয়ে থাকছেন।
দুই বোনকে বিয়েও দেন। এরপর নিজেও বিয়ে করে চেয়েছিলেন সুখের সংসার করতে। কিন্তু তা হয়নি। এবার তার সুখের সংসারে আঁধার নেমে এসেছে। স্বামীকে হাসপাতালে রেখে ওষুধের টাকা জোগাড় করতে লকডাউনের মাঝেও ইজিবাইকের স্ট্রিয়ারিং ধরেছেন।
জানা যায়, প্রায় সাত মাস ধরে তার স্বামী অসুস্থ। প্রথম দিকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল নিয়ে এলে চিকিৎসক সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। পরের ইজিবাইক চালিয়ে দুটি ইজিবাইক নিজে কিনেছিলেন। সে দুটি ইজিবাইকের একটি বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছেন তখন। আরেকটি চালিয়ে সংসার চালিয়েছেন। তখন সাময়িক ভালো হলে বাড়ি ফিরে আসেন স্বামীকে নিয়ে।
কয়েক দিন পর আবারও হৃদয় চন্দ্র দত্তের পেটব্যথা শুরু হয়। তখন সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করান। এখন আবারও অসুখ বেড়েছে। চিকিৎসক বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব সিলেট নিয়ে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু যাবেন যে সিলেট, সেই গাড়ি ভাড়াই নেই তার কাছে।
জীবনসংগ্রামে হার না মানা যাত্রীকে ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী ‘ক্যাটাগরিতে’ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে তাকে এই সম্মাননা দেয় জেলা প্রশাসন।
যাত্রীর স্বামী জামালগঞ্জ উপজেলার চানপুর গ্রামের হৃদয় দত্ত বাড়ি থেকে অভিমান করে সুনামগঞ্জ পৌর শহরে এসে রিকশা চালাতেন। ৯ বছর আগে হৃদয়কে বিয়ে করেন যাত্রী। কিন্তু তিনি বর্মণ বংশের হওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয়নি। এখন শহরতলির নবীনগরে দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন।
হৃদয় চন্দ্র দত্ত সাত মাস ধরে বিছানায়। রিকশা নিয়ে বের হতে পারেন না। এই সাত মাসে বাসা ভাড়াসহ ৬ সদস্যের পরিবারের খরচ একাই টানছেন যাত্রী।
আমার তিন ছেলে মেয়ে। সঙ্গে স্বামী হৃদয় চন্দ্র দত্ত ও মা শুভা রানী বর্মণ থাকেন। আমার স্বামীর অবস্থা খুবই খারাপ। ডাক্তার বলেছে সিলেট নিয়ে যেতে। সবচেয়ে ভালো হয় ঢাকা নিয়ে গেলে। এখন সিলেট নিয়ে যাওয়ারই ক্ষমতা নেই আমার। গতবারও একবার সিলেট নিয়ে গেছি। তখন ১০ দিন ভর্তি ছিলাম। পরে দেখা গেছে আবার একই ব্যথা, জ্বর, বমি। পরে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করাই।
তিনি বলেন, আমি খুব কষ্টে আছি। আমার স্বামী এখন মৃত্যুশয্যা। চিকিৎসা না করালে বাঁচাতে পারব না। যদি কেউ আমারে দয়া করে সাহায্য করেন, তাহলে আমার স্বামীকে বাঁচাতে পারব। হৃদয় চন্দ্র দত্ত বলেন, আমার পেটের ডান দিকে ব্যথা। সে ব্যথার কারণে কোমরে ও বুকে ব্যথা করে। অসুখ হওয়ার পর থেকে অটো নিয়ে বের হতে পারছি না। এখন আমার পরিবারের জন্য বাঁচতে চাই।
যাত্রীর মেয়ে ঝুমা দত্ত। বয়স ৬ বছর। হাসপাতালে অসুস্থ বাবার পাশে বসে কান্না করছে সে। তারও চাওয়া তার বাবা যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। ঝুমা বলে, বাবা অসুস্থ। আমার বাবা সুস্থ হোক আমরা চাই। আমার বাবা সুস্থ না হলে আমরাও মারা যাব। আমার বাবাকে সুস্থ করে দিন। হৃদয় চন্দ্রের চিকিৎসক মেডিকেল অফিসার ডা. বিষ্ণু প্রসাদ চন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তার কিডনিতে ইনফেকশন হয়েছে। আমাদের হাসপাতালে তিনি আগেও ভর্তি ছিলেন। পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইউরোলজি বিভাগে চিকিৎসা নেন। এখন আবার তিনি অসুস্থ। এখানে প্রস্রাবের সমস্যা ও পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি আছেন। কিন্তু সদর হাসপাতালে ইউরোলজি বিভাগ না থাকায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, তার কিছু আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। কারণ, সিলেটে যাতায়াত করা, থাকা― সব মিলিয়ে কিছু টাকার প্রয়োজন। দ্রুত চিকিৎসা করাতে পারলে তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। নয়তো দীর্ঘমেয়াদি এই ইনফেকশন থাকলে কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।