সুনামগঞ্জের সীমান্তের ওপারে ভারতের আসামের নলিকাটা থানার ঘোমাঘাট গ্রাম। এপারে তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েরগড় গ্রাম। দুই গ্রামেরই প্রত্যেক বাড়ির গাছ এখন কাঁঠালে পরিপূর্ণ। বলা চলে, দুটিই কাঁঠালের গ্রাম। এপারের লাউড়ের গড়ে ৫০০’এর মত বাড়ি আছে। প্রত্যেক বাড়িতে কমপক্ষে ১০ টি করে কাঁঠাল গাছ আছে।
ফলন ও ভাল, তাই গ্রামের সকল মানুষের মূখে হাসি।
শ্রী হট্রের অর্থাৎ সিলেটের তিন ভাগ তিন জন পৃথক নৃপতি দ্বারা শাসিত হত। গৌড়, লাউড় ও জয়ন্তিয়া এই তিন খণ্ডের নৃপতির অধীনস্ত ছিলেন আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমি মালিক। লাউড় রাজ্য ছিল সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ জেলার কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। লাউড় ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য। তাহিরপুরের সীমান্ত এলাকায় লাউড়ের রাজধানী ছিল। এই রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ সীমান্তের হলহলিয়া গ্রামে এখনো বিদ্যমান। হলহলিয়া থেকে লাউড়ের গড়ের দুরুত্ব খুব বেশি নয়। ঐতিহ্যবাহি এই এলাকার লাউড়ের গড় গ্রামটি এখন কাঁঠালের গ্রাম হিসাবই পরিচিত। আলাদা বাগান করে কাঁঠাল লাগানো খুব কম। প্রত্যেকের বাড়িই একেকটি কাঁঠাল বাগান। গ্রামের এমন কোন বাড়ি নেই যার বাড়িতে কমপক্ষে ১০ টি কাঁঠাল গাছ নেই। এমনও বাড়ি আছে যার বাড়িতে ১০০ থেকে ১৫০ টি কাঁঠাল গাছ আছে।
গ্রামের বাসিন্দা গণমাধ্যম কর্মী আলম সাব্বির বললেন, পাহাড়ের কাছাকাছি অপেক্ষাকৃত উঁচু গ্রাম লাউড়ের গড়ের মাটিতে বেলে ও দোয়াস মাটির সমন্বয় আছে। এই জন্য এই মাটিতে কাঁঠাল গাছ হয়। এই গ্রামে দুই ধরণের কাঁঠাল গাছ হয়। এক প্রকারের কাঁঠালকে বলা হয় খাঁজা কাঁঠাল, আরেকটা হাজারী কাঁঠাল। খাঁজা কাঁঠালের খোয়া বড় হয়, এই কাঁঠালকে করচা কাঁঠাল বলা হয়, এই কাঁঠালের ভেতর কোয়া কম থাকে। হাজারী কাঁঠালের কোয়া অপেক্ষাকৃত ছোট ও নরম হয়, ভেতরে কোয়া থাকে বেশি। লাউড়ের গড়ের কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল আসা শুরু হয় ফাল্গুন মাসে, জৈষ্ঠ্য থেকে আষাড় মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত গাছে কাঁঠাল ফাকে।
আলম সাব্বির জানালেন, শাহ্ আরেফিন (র.) টিলার পাশের এই গ্রামে রেওয়াজ আছে কাঁঠাল মওসুমে সকল আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিজের গাছের বাছাই করা কাঁঠাল পাঠানো। এরপর বিক্রি।
লাউড়েগড়ের বাসিন্দা আশরাফ মিয়া বলেন, গাছের বয়স যত বাড়বে, কাঁঠাল তথই বেশি ধরবে। ৫০-৬০ বছর বয়সি কাঁঠাল গাছও এই গ্রামে আছে। এসব গাছে ১০০ থেকে ১৫০ টি কাঁঠাল আসে। অর্থাৎ এক মওসুমে এক গাছে কাঁঠাল বিক্রি করে আয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
লাউড়েগড় গ্রামের বাসিন্দা রহমত আলী জানালেন, অনেকে কাঁঠাল ব্যবসায়ীদের কাছে আগেই কাঁঠাল গাছের মওসুমের কাঁঠাল বিক্রি করে দেন।
তিনি জানান, এই গ্রামে এমন ব্যক্তিও আছেন যার প্রতিবছর কাঁঠাল বিক্রি করে আয় হয় লাখ টাকার উপরে। অনেকের দিন বদলে গেছে কাঁঠাল বিক্রির আয়ে। রমজান উপলক্ষে বাত্ত্বি হওয়া (ভেতরে খোয়া হয়েছে) কাঁঠাল দূর দূরান্ত থেকে এসে কিনে নিচ্ছেন অনেকে।
সুনামগঞ্জ শহরের বাসিন্দা হাবিব ও আল ইমরান শনিবার লাউড়ের গড়ে গিয়েছিলেন কাঁঠাল কিনতে। বললেন, বাজারের কাঁঠাল এখন ভালো হয় না। এই গ্রামে থেকে এর আগেও নিয়েছি, এবারও আসছি সুস্বাদু কাঠাল নিতে। সুনামগঞ্জের কাঁঠাল ব্যবসায়ী আশিক মিয়া বললেন, এখন লাউড়ের গড়ের কাঁঠালের ভরা মওসুম নয়। তবু অটো রিক্সায় করে ৫০ টি কাঁঠাল লাউড়ের গড় থেকে এনে সুনামগঞ্জে বিক্রি করে দ্বিগুন লাভ করেছেন তিনি।
স্থানীয় বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আফতাব উদ্দিন বললেন, লাউড়ের গড়ের মাটি কাঁঠাল চাষের উপযোগি। তবে কৃষি বিভাগ উদ্যোগি হলে এই গ্রামে কাঁঠালের ফলন ভালো হতো।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েগড় গ্রামে কাঁঠাল বেশি হয়, কাঁঠালের গ্রাম হিসাবেই এই গ্রামের পরিচিতি বাড়ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের সব রকমের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি তাঁর।