২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে এই পর্যন্ত একদিনও ছেলেটির ক্লাস হয় নি। অনলাইনে কিংবা সরাসরি কোনভাবেই পাঠদান হয় নি। বাড়িতে পড়াশুনা করানোও দায় হয়ে পড়ছে, বলছে পরীক্ষা তো হবে না, তাহলে পড়ে লাভ কি’। আক্ষেপ করে নিজের সন্তানের পড়াশুনার অমনোযোগিতার কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বিশ্বভরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাজ দেব নাথের বাবা পদ্মনগর গ্রামের ধীরেন্দ্র দেব নাথ ।
কেবল বিশ্বম্ভরপুরের সাজ দেব নাথ নয়, হাওরাঞ্চলের গ্রামিণ জনপদের প্রত্যেকটি উপজেলার শিক্ষার্থীর এমন করুণ অবস্থা।
জামালগঞ্জের বেহেলী গ্রামের রানু পাল জানালেন, তার দুই সন্তান ষষ্ট শ্রেশি পড়ুয়া রাজ পাল ও দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া রুহিত পাল একবছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যালয়ের শিক্ষকের দেখা পায় নি।
এই অবস্থায় অভিভাবকদের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও উদ্বিগ্ন। শিক্ষকরা মনে করছেন, শিক্ষা-দীক্ষার এই ক্ষতি পুষানো কঠিন হবে।
বিশ^ম্ভরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাজ্জাদুর রহমান বললেন, গেল বছরের ডিসেম্বর মাসে চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট করানো হয়েছিল। এই বছরের জানুয়ারিতে আবার অ্যাসাইনমেন্ট শুরু হয়েছিল। করোনার জন্য এই কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে চলবে না। শিক্ষা কার্যক্রম কিভাবে সচল করা যায়, না ভাবলে ক্ষতি হয়ে যাবে।
তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের মোয়াজ্জেমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজবাহুল আলম বললেন, শিক্ষা-দীক্ষার বেহাল দশা হাওরপাড়ে, অনলাইনে পাঠদানের কোন ব্যবস্থা নেই। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, অভিভাবক বা শিক্ষার্থীদের অ্যান্দ্রোয়েড ফোন না থাকায় সেটি থেমে যায়। এই অবস্থায় গেল বছরের ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন যোগাযোগ নেই। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। এই অবস্থায় গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত বলা চলে।
মিজবাহুল আলমের মতে প্রতি ক্লাসের ২০ জন শিক্ষার্থীকে স্কুলে এনে সামাজিক দুরুত্ব মেনে পাঠদান শুরু করা জরুরি।
বাংলাদেশ বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক কর্মচারী ফোরামের সুনামগঞ্জ জেলা সভাপতি মো. মোদাচ্ছির আলম বললেন, গ্রামে বিয়ে সাদী, আচার অনুষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই হচ্ছে, কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নেই। জেলার ২২৫ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই শিক্ষা-দীক্ষার করুণ হাল। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয় খুলে দেওয়া ছাড়া এখন আর কোন বিকল্প নেই।
জেলা কলেজ বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি শুভক্সকর তালুকদার মান্না বললেন, ক্লাসে অনলাইনে কোনভাবেই পাঠদান হচ্ছে না। জেলার ৩৫ টি কলেজের সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পড়াশুনার ধারে কাছেও নেই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ না থাকায় নিজেরা যে শিক্ষার্থী এটা ভুলেই যাচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন না দেওয়ায় এমপিবিহীন শিক্ষক কর্মচারীদেরও খারাপ অবস্থা। এই অবস্থায় যারা বোর্ডের পরীক্ষার্থী তাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিদিন এবং অন্যদের সপ্তাহে একদিন হলেও পাঠদান শুরু করা জরুরি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে জরুরিভাবে চিন্তা করার দাবি করছি।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বললেন, শহরের এবং গ্রামের শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধার ফারাক অনেক বেশি। গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝড়ে পড়ার হারও বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় বিষয়টি এখন ভেবে দেখা জরুরি।